| |
               

মূল পাতা জাতীয় আইন-আদালত অগ্নিসংযোগ ও বিস্ফোরক মামলায় কারাবন্দি, শয্যাশায়ী এমনকি প্রবাসে থেকেও আসামি


সমকালের প্রতিবেদন

অগ্নিসংযোগ ও বিস্ফোরক মামলায় কারাবন্দি, শয্যাশায়ী এমনকি প্রবাসে থেকেও আসামি


রহমত নিউজ ডেস্ক     03 November, 2023     03:33 PM    


ঢাকার মহাসমাবেশ ঘিরে সহিংসতার পর সারাদেশে বিভিন্ন মামলায় আসামি করা হয়েছে কারাবন্দি, দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী, পুলিশ হেফাজতে থাকা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি নেতাকর্মী, এমনকি প্রবাসীকেও। অনেক মামলার সাক্ষী নিজেই ককটেল, লাঠি ও পেট্রোল জব্দের কথা জানেন না। ঘটনাস্থলের আশপাশের লোকজনও বিস্ফোরণের শব্দ কিংবা কাউকে গাড়ি ভাঙতে দেখেননি। তার পরও এসব অভিযোগেই মামলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, পুলিশের ওপর হামলা ও ককটেল বিস্ফোরণের মামলায় আসামি করা হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতাকেও। বিএনপির দাবি, সারাদেশে এ ধরনের শত শত গায়েবি মামলা হচ্ছে নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে, যেমনটি ২০১৮ সালেও নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে করা হয়েছিল।

গত শনিবার সংঘর্ষের ঘটনায় শুধু ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন থানায় ৩৭ মামলায় বিএনপির ১ হাজার ৫৪৪ নেতাকর্মী ও অজ্ঞাতপরিচয় কয়েক হাজার মানুষকে আসামি করা হয়েছে। কিছু মামলা ক্ষতিগ্রস্তদের; বেশির ভাগ মামলার বাদী পুলিশ। পল্টন থানায় পুলিশ হত্যা, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলাসহ চারটি মামলায় আসামি করা হয়েছে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অনেক সিনিয়র নেতাকে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মনির চেয়ারম্যান ও ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আক্তার হোসেনকে গত শুক্রবার গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের আসামি করা হয়েছে পরদিন শনিবার মহাসমাবেশ থেকে সংঘর্ষে জড়িয়ে পুলিশ কনস্টেবল হত্যার দায়ে। পুলিশ হেফাজতে থেকে কীভাবে মনির ও আক্তার হোসেন কনস্টেবল হত্যায় জড়িত হলেন– জানতে চাইলে পল্টন থানার ওসি সালাহউদ্দিন মিয়া বলেন, সংঘর্ষের পর যে পরিস্থিতি হয়েছে তাতে অনেক সোর্স ও বিভিন্ন মাধ্যম যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে তদন্ত শেষে জড়িতদের বিরুদ্ধেই চার্জশিট দেওয়া হবে।

গত রবিবার দেশব্যাপী হরতাল চলাকালে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে গাড়ি ভাঙচুরের এক মামলায় ৭৫ জনের নামে ও বহু অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে আসামি করেছে পুলিশ। স্বজনরা জানিয়েছেন, এ মামলার ৫১ নম্বর আসামি নুরুল ইসলাম নুরু দুই মাস ধরে আমেরিকায়। হান্নান নামের আরেকজন ঘটনার আগে থেকেই কারাবন্দি। অশীতিপর এম এ তাহের এক বছর ধরে শয্যাশায়ী। গত ১৫ বছর কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেই সম্পৃক্ত নন তিনি। তার পরও তিনি গাড়ি ভাঙচুর করেছেন বলে এজাহারে উল্লেখ রয়েছে। এ মামলার ৫৪ নম্বর আসামি তাজুল ইসলাম মহাসমাবেশের দিন গ্রেপ্তার হয়ে জেলহাজতে। আর ২০ অক্টোবর থেকে কারাগারে ৫৫ নম্বর আসামি মুরাদ কাদরী। গত শনিবার রাত ১২টার দিকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের কাঁচপুর ব্রিজ এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণ, অগ্নিসংযোগ ও নাশকতার অভিযোগ এনে পরদিন বিএনপির ৮৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন সোনারগাঁ থানার এসআই মহিবুল্লাহ। ১৯ নম্বর আসামি হাজি মোমেন খান কাঁচপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। পরিবারের দাবি, গত ১৯ অক্টোবর থেকে চিকিৎসার জন্য ভারতে মোমেন। ৩২ নম্বর আসামি একই ইউনিয়ন ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সালেহ মোহাম্মদ শান্ত গত ২৩ জানুয়ারি থেকে মালয়েশিয়ায়।

গত শনিবার রাতে যশোর সদরের হামিদপুরে দুটি বাস তল্লাশি করে বিএনপির ৬৬ নেতাকর্মীকে আটক করে পুলিশ। এ ঘটনায় নাশকতা মামলায় তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ হাতবোমা, বাঁশের লাঠি, পেট্রোল ও গ্যাসলাইটার জব্দের দাবি করা হয়। এর মধ্যে জেলা বিএনপির সদস্য মুনীর আহমেদ সিদ্দিকী বাচ্চুকে দু’বার আসামি দেখানো হয়েছে। এ মামলায় পুলিশের সাক্ষী টাইলস মিস্ত্রি বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘পুলিশ একটি কাগজে সই করতে বললে ভয়ে করেছি। এর বাইরে কিছুই জানি না।’

মামলায় উল্লেখ করা লিটন ট্রাভেলসের চালক আলম হোসেন বলেন, ‘পুলিশ গাড়ি তল্লাশি ও কয়েক যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে। এর পর বেশ কয়েকজনকে আটক করে গাড়িসহ থানায় নিয়ে যায়। এ সময় কিছু জব্দ করা হয়নি।’ শিবচর স্টার ডিপোর ব্যবস্থাপক সরোয়ার হোসেন বলেন, ‘আটকরা কে কোন দল করে জানি না। গাড়ি থেকে পুলিশ কিছুই উদ্ধার করেনি।’

বাদী চাঁনপাড়া পুলিশ ক্যাম্পের এসআই আমিনুল ইসলাম এজাহারের বক্তব্যই তাঁর বলে জানান। যশোর কোতোয়ালি থানার ওসি আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে মামলা হয়েছে। সাক্ষীরা ভয়ে ভিন্ন কথা বলছেন।

গত শনিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে ফরিদপুরের সালথা উপজেলা সদরের বাইপাস সড়কের চৌরাস্তার মোড়ে বিএনপির ডাকা হরতালের সমর্থনে মিছিল থেকে ককটেল বিস্ফোরণ ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় মামলায় মাঝারদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শাহীদুজ্জামান শাহিদকে আসামি করা হয়েছে। শাহীদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আসামি হিসেবে নাম দেখে বিস্মিত হয়েছি। বাদী এসআই পরিমলকে ফোন দিলে দুঃখ প্রকাশ করে ভুল হয়ে গেছে বলে জানান।’ গত রবিবার সকাল সোয়া ৭টায় ময়মনসিংহের ভালুকার ভরাডোবা বাসস্ট্যান্ড-সংলগ্ন হারুনের কাঠের মিলের সামনে ককটেল বিস্ফোরণ ও গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগ তুলে বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। তবে ওই এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘সকালে এ রকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। ককটেল বিস্ফোরণ হলে তো শব্দ শুনতাম!’

মঙ্গলবার নাশকতার অভিযোগে কক্সবাজারের উখিয়া থানায় একটি মামলায় আসামি করা হয়েছে আব্দুস সালাম নামে এক সৌদি প্রবাসীকে। গত ২৪ জানুয়ারি থেকে আব্দুস সালাম সৌদি আরব আছেন বলে জানান তাঁর ভাই সাইফুল ইসলাম। সমকালকে তিনি বলেন, ‘আব্দুস সালাম কোনো দলের সঙ্গে কখনও জড়িত ছিল না। সংসারের অভাব মেটাতে সৌদি গিয়ে আজও ফেরেনি।’ জানতে চাইলে উখিয়া থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘সরাসরি নাশকতায় জড়িত ছাড়াও দেশ-বিদেশে বসে পরিকল্পনারী ও নির্দেশদাতাদের আসামি করা হয়েছে। তবে নিরপরাধ কেউ থাকলে তদন্তে ধরা পড়বে।’ যদিও এজাহারে তাদের পরিকল্পনাকারী হিসেবে উল্লেখ না করে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে নাশকতা করেছেন দাবি করা হয়েছে। এ বিষয়ে ওসি মন্তব্য করতে রাজি হননি। গত সোমবার রাতে পিরোজপুরের ইন্দুরকানীর মধ্য বালিপাড়ার একটি টং চায়ের দোকানে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ইদ্রিস আলী বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরে ইদ্রিস আলী সাংবাদিকদের বলেন, ‘অন্ধকারে কে দোকানে আগুন দিয়েছে দেখিনি। পড়তে জানি না। পুলিশের কথায় টিপসই দিয়েছি।’ ইন্দুরকানী থানার ওসি আল মামুন জানান, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির তথ্যে মামলা ও পরে দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

রবিবার সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানায় বিএনপি-জামায়াতের অন্তত ১৬০ জনের বিরুদ্ধে কাশিমাড়ী বাজারে ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগে মামলা করে পুলিশ। ঘটনাস্থলের পাশেই কাশিমাড়ী ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সভাপতি রেজাউল ইসলামের মাছের ঘের। সমকালকে তিনি বলেন, ‘ককটেল বিস্ফোরণের কোনো শব্দ শুনিনি। লাঠি, পেট্রোল বোমা উদ্ধারের ঘটনাও ঘটেনি। অভিযোগ শতভাগ মিথ্যা।’ চট্টগ্রামের রাউজান থানায় গত ১৭ অক্টোবর ডাকাতির প্রস্তুতি ও অস্ত্র মামলায় আসামি করা হয়েছে উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ফিরোজ আহমেদকে। অথচ তিনি ওমরাহ করতে গত ৪ অক্টোবর সৌদি আরব গেছেন। একই মামলায় যুবদল নেতাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে যুবদল নেতাকে তিন দিন আগেই ধরে নিয়ে যায় বলে পরিবারের দাবি। গত ৩১ জুলাই যুবলীগ নেতাকে মারধর, গাড়ি ভাঙচুর ও বিস্ফোরক আইনে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে ইউসুফ চৌধুরীকে। অথচ তিনি দুই বছর ধরে সংযুক্ত আরব আমিরাত আছেন বলে জানিয়েছেন তাঁর স্ত্রী খালেদা বেগম। গত ২৮ জুলাই বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করেন চন্দনাইশ পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন। মামলায় ৩ নম্বর আসামি হজ কাফেলার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিএনপি নেতা মঞ্জুর মোর্শেদ, ৪ নম্বর আসামি সাইফুল করিম গত ১৮ জুন হজ পালনের জন্য সৌদি আরব যান। এখনও তারা দেশে ফেরেননি। গত ২৭ জুলাই হাটহাজারী থানায় ১২১ বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বিস্ফোরক আইনে মামলা করেন চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আয়মান আওসাফ চৌধুরী। এজাহারে ঘটনাস্থলে ককটেল বিস্ফোরণের যে বর্ণনা রয়েছে, সে বিষয়ে স্থানীয়দের দাবি, ওই দিন এ ধরনের কোনো ঘটনাই ঘটেনি।